বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি হল বঙ্গদেশের একটি ঐতিহ্য মণ্ডিত সৌর পঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতন বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আকাশে রাশিমণ্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়ে থাকে। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ।
বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে। বঙ্গাব্দ সব সময়ই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর চেয়ে ৫৯৩ বছর কম। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী আজকের তারিখ হল ২৯ চৈত্র, ১৪২১ বঙ্গাব্দ।
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে ২টি মত চালু আছে। প্রথম মত অনুযায়ী - প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার ও ওড়িশার অধিকাংশ এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জীর বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে[২] হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে[৩] ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।[৪]
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ "সূর্যসিদ্ধান্ত" থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছে -
বাংলা সন অন্যান্য সনের মতনই ৭ দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতনই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে। ইংরেজি বা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে।
৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বরাহমিহির পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি পাঁচটি খণ্ডে সমাপ্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। পঞ্চসিদ্ধান্তিকার পাঁচটি খণ্ডের নাম– এই সিদ্ধান্তগুলো হল– সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। প্রাচীন দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে 'সূর্যসিদ্ধান্ত' একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বরাহমিহিরের পরে ব্রহ্মগুপ্ত নামক অপর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী (জন্ম ৫৯৮) একটি সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থটির নাম ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থটি খলিফা আল-মনসুরের আদেশে সিন্দহিন্দ নামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস নির্ধারিত হয়, সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীন কালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো– মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। একেকটি সংক্রান্তিকে একেকটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।[৫] যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১লা বৈশাখ (পয়লা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে, ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে।[৫]
ভারতে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের মাসসমূহ এবং তাদের দৈর্ঘ্য :
ক্রম | নাম | দিনসংখ্যা | যে রাশিতে সূর্য অবস্থিত |
---|---|---|---|
১ | বৈশাখ | ৩০ / ৩১ | মেষ |
২ | জ্যৈষ্ঠ | ৩১ / ৩২ | বৃষ |
৩ | আষাঢ় | ৩১ / ৩২ | মিথুন |
৪ | শ্রাবণ | ৩১ / ৩২ | কর্কট |
৫ | ভাদ্র | ৩১ / ৩২ | সিংহ |
৬ | আশ্বিন | ৩০ / ৩১ | কন্যা |
৭ | কার্তিক | ২৯ / ৩০ | তুলা |
৮ | অগ্রহায়ণ | ২৯ / ৩০ | বৃশ্চিক |
৯ | পৌষ | ২৯ / ৩০ | ধনু |
১০ | মাঘ | ২৯ / ৩০ | মকর |
১১ | ফাল্গুন | ২৯ / ৩০ | কুম্ভ |
১২ | চৈত্র | ৩০ / ৩১ | মীন |
বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর মতনই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এই প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য। জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতনই বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করে। এগুলো হচ্ছেঃ-
বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী সরকারীভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে। যদিও ভারতের পশ্চিম বাংলায় পুরনো বাংলা সনের প্রচলনই থেকে গেছে।
বাংলাদেশে সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের মাসসমূহ এবং তাদের দৈর্ঘ্য :
ক্রম | নাম | দিনসংখ্যা | গ্রেগরীয় তারিখ অনুসারে মাসের দৈর্ঘ্য |
---|---|---|---|
১ | বৈশাখ | ৩১ | ১৪ এপ্রিল - ১৪ মে |
২ | জ্যৈষ্ঠ | ৩১ | ১৫ মে - ১৪ জুন |
৩ | আষাঢ় | ৩১ | ১৫ জুন - ১৫ জুলাই |
৪ | শ্রাবণ | ৩১ | ১৬ জুলাই - ১৫ অগস্ট |
৫ | ভাদ্র | ৩১ | ১৬ অগস্ট - ১৫ সেপ্টেম্বর |
৬ | আশ্বিন | ৩০ | ১৬ সেপ্টেম্বর - ১৫ অক্টোবর |
৭ | কার্তিক | ৩০ | ১৬ অক্টোবর - ১৪ নভেম্বর |
৮ | অগ্রহায়ণ | ৩০ | ১৫ নভেম্বর - ১৪ ডিসেম্বর |
৯ | পৌষ | ৩০ | ১৫ ডিসেম্বর - ১৩ জানুয়ারি |
১০ | মাঘ | ৩০ | ১৪ জানুয়ারি - ১২ ফেব্রুয়ারি |
১১ | ফাল্গুন | ৩০ / ৩১ | ১৩ ফেব্রুয়ারি - ১৪ মার্চ |
১২ | চৈত্র | ৩০ | ১৫ মার্চ - ১৩ এপ্রিল |
পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে এদিন উদযাপন করা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল ১৪ তারিখে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তা উদযাপন করা হয় সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। এটি পাশ্চ্যাতের বর্ষপঞ্জির মতন নির্দিষ্ট নয়। ভারতের বাঙালিরা নতুন বছর উদযাপন করে এপ্রিল ১৪ বা ১৫ তারিখে।
ভারতের সমস্ত বঙ্গভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে সনাতন নিরয়ণ (জ্যোর্তিমণ্ডলে তারার অবস্থানের প্রেক্ষিতে গণিত, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর প্রকৃত সময়ই নিরয়ণ বর্ষপঞ্জী। অর্থাৎ নিরয়ণ বর্ষপঞ্জীর দৈর্ঘ্য হল ৩৬৫.২৫৬৩৬০২ সৌর দিবস যা ক্রান্তীয় সায়ন বর্ষপঞ্জি থেকে ২০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড দীর্ঘ।) বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বর্ষপঞ্জী ক্রান্তীয় বা সায়ন বর্ষপঞ্জী (যেমন সংস্কারকৃত বাংলা সন এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী) থেকে ভিন্ন। এই উভয় ধরণের বর্ষপঞ্জির মধ্যে সময়ের যে গাণিতিক পার্থক্য রয়েছে তার কারণেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নতুন বর্ষ শুরুতে দিনের পার্থক্য হয়। এই সময়ের পার্থক্যের কারণে নিরয়ণ সৌর বর্ষপঞ্জিতে মাসের দৈর্ঘ্যে পার্থক্য রয়েছে।
সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ফাল্গুন (যা ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি শুরু হয়) মাস প্রতি চতুর্থ বর্ষে ৩১ দিনের হয়। মিল রাখবার উদ্দেশ্যে
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস